আজ ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

হতাশা-প্রতিকূলতা ঠেকাতে যত্নবান হতে হবে পরিবার-সমাজকে

প্রতিটি মানুষই তার নিজের জীবনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সবাই চায় পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচতে। তবে পৃথিবীতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে সবার চাওয়া কিংবা জীবনযাপনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা একই রকম থাকে না। মানুষের চাওয়ার ভিন্নতা, হতাশা আর অপূর্ণতাকে সহ্য করতে না পেরে অনেকেই নিজেকে অকালেই শেষ করে ফেলেন। বর্তমান সময়ে এই আত্মহত্যা একটি বড় সমস্যা। এটি শুধু একটি পরিবারের জন্যই নয়, দীর্ঘ মেয়াদে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও প্রকট আকার ধারণ করে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ হতাশ হলে খুব ছোট কারণেও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন নিজেকে একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এজন্য আশপাশের মানুষদের ব্যাপারে সবাইকে অনেক বেশি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সার্বিকভাবে মৃত্যুর ১৭তম প্রধান কারণ আত্মহত্যা। অবশ্য ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ আত্মহত্যা। বিশ্বে প্রতিবছর সাত লাখ তিন হাজার মতো মানুষ আত্মহত্যা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, সার্বিকভাবে মৃত্যুর ১৭তম প্রধান কারণ আত্মহত্যা। অবশ্য ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ আত্মহত্যা। বিশ্বে প্রতিবছর সাত লাখ তিন হাজার মতো মানুষ আত্মহত্যা করে। এ হিসাবে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। যদিও দারিদ্র্য সরাসরি আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িত নয়, তবে এটি আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। ডব্লিউএইচও’র এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ আত্মহত্যা করে তার ৭৭ শতাংশই হয়ে থাকে কম আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম দৈনিক তারুণ্যকে বলেন, মানুষ হুট করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না, একদিনে ওই অবস্থায়ও পৌঁছে যায় না। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একসময় মনে করে আর পারছি না। তখন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে আত্মহত্যার পথে এগোনোর সময় কিন্তু তার অবস্থানটা বোঝা যায়। সে সময় দেখা যায় ওই ব্যক্তি কিছুটা একা হয়ে পড়ছেন, চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন, কারও সঙ্গে মিশছেন না। তখন এই অবস্থা দেখা বোঝা যায় তিনি কোনো সমস্যায় আছেন। কাজেই সে সময় যদি তার সমস্যা সম্পর্কে জানা যায়, কিংবা তার সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তাকে এই পথ থেকে ফেরানো সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠীরা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা যায়, দেশে ২০২১ সালে ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ১০ হাজার ২৫৬ ও ১১ হাজার। ২০১৯-২০ সময়কালে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন, যাদের মধ্যে ২০-৩৫ বছর বয়সীই সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য বছরে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হলেও এ সময়ে নারীদের তুলনায় পুরুষের আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল তিনগুণ।
মানুষ হুট করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না, একদিনে ওই অবস্থায়ও পৌঁছে যায় না। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একসময় মনে করে আর পারছি না। তখন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতাও উদ্বেগজনক। ২০২১ সালে এই পথ বেছে নিয়েছেন ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’র তথ্য মতে, গত বছর আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন বা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিকেল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩। এর আগে ২০২০ সালে আত্মহত্যা করেন ৭৯ জন শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সঠিক কাউন্সেলিং। কিশোর- কিশোরীদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন তাদের মা-বাবা। এসময় তাদের আবেগ অনেক বেশি থাকে। একটুতেই ওরা অভিমান করে ভেঙে পড়ে, হতাশা গ্রাস করে। মা-বাবার লক্ষ্য রাখতে হবে সন্তানদের মধ্যে এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেথা যাচ্ছে কি না। তাদের উচিত সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা। এতে শিশুরা নিজেদের বিষয়গুলো মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার করবে। সন্তানদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক রাখা যাবে না যাতে তারা নিজের মনের কথা না বলে উল্টো ভয় পায়। তাদের কথা শুনতে হবে। সমস্যা হলে বোঝাতে হবে, পরামর্শ কিংবা সমাধান দিতে হবে।
তবে, এই অবস্থা (মানসিক সমস্যা) যদি বেশি প্রকট হয়, পরিবার যদি সমাধান করতে না পারে, তবে দ্রুত সাইকোলজিস্ট বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, সামাজিক স্টিগমা (কলঙ্কের ভয়) থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের সমাজে এখনো এক প্রকার ভীতি কাজ করে অন্যরা কী বলবে কিংবা সমাজে হেয় হবে কি না ইত্যাদি। এসব থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ১০ হাজার ২৫৬ ও ১১ হাজার। ২০১৯-২০ সময়কালে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন, যাদের মধ্যে ২০-৩৫ বছর বয়সীই সবচেয়ে বেশি।
অবশ্য গত চার বছরে দেড় হাজার আত্মহত্যা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় জরুরি সেবা হটলাইন ৯৯৯। ৯৯৯ এর পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ৯৯৯ হচ্ছে জরুরি সেবা। আমাদের কাছে অনেক সময়ই আত্মহত্যা চেষ্টার তথ্য জানিয়ে কল এসে থাকে। অনেক সময় ভিকটিম নিজেই কল দিয়ে আমাদের কাছে জানান যে, তিনি পারিবারিক কিংবা কোনো খারাপ লাগার কারণে এই কাজ করছেন। এক্ষেত্রে আমরা কৌশলে তার অবস্থান জেনে নিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করে থাকি। এছাড়া অনেক সময় প্রতিবেশী কিংবা ভিকটিমের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কল দিয়ে আমাদের জানান। এছাড়াও কেউ এ ধরনের কাজ করতে পারেন এমনটা মনে হলে, কিংবা তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের পোস্টসহ নানা বিষয়ে আমাদের কাছে কল আসে। এক্ষেত্রে আমরা ভিকটিমের অবস্থান জেনে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে অন্যদের কাছে আত্মহত্যার কারণ ছোট মনে হলেও ভিকটিমের কাছে তা ছোট নয়। ভিকটিমের কাছে ওই মুহূর্তে ওটাকে বড় কারণ মনে হওয়ায় তারা আত্মহননের পথ বেছে নেন। এ অবস্থায় কারও সমস্যাকেই আমাদের ছোট করে দেখা উচিত নয়। একই সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকা আত্মহনন প্রতিরোধে রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানসিক স্বাস্থ্যবিদসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ